অভিজাত এলাকার আলীশান বাড়িটার বিশাল ড্রইংরুম। দামী দামী সব আসবাবপত্রে ঠাসা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শফিকুর রায়হানের বসার ঘর। বিদেশী দামি সব শোপিস ঘর জুড়ে। দেয়ালে সুদৃশ্য সব ওয়ালমেট। এসবের মাঝেই দেয়ালের এককোণে টাঙানো কাঁচে বাধানো এক পোষ্টার। রক্ত দিয়ে লেখা বাংলা বর্ণমালা। পোষ্টারটি এ ঘরের দেয়ালে বেমানান নাকি ঘরটির আভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছে সে বিতর্কে না গিয়ে আমরা চলে যাই গল্পের গভীরে। রক্তাক্ত এ পোষ্টারটি নিয়েই আমাদের এ গল্প " পোষ্টার "।
এই মুন্না ! কিরে কই গেলি? জি্ব আইতাছি। কন কি লাগবো? কি লাগবো মানে! ঠান্ডায় কাঁপতাছি। শীগগীর চা নিয়ে আয়। টাকা ধর। চার কাপ চা নিয়ে আয়।
আবার পোষ্টার লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা চারজন-ফিরোজ,শান্ত,রাজীব আর কাজল। পোষ্টারে পোষ্টারে ছেয়ে যাবে পুরো ঢাকা শহর। ভয় পেয়ে যাবে শাসক শ্রেণী। দাবী মেনে নিতে বাধ্য হবে। কাজল বলে, দেখিস আমরা দাবী আদায় করে ছাড়ব। বাপ বাপ করে দাবী মেনে নিবে। শান্ত বলে, অত সহজে মেনে নেবে বলে মনে হয়না। রাজীব বলে, প্রয়োজনে রক্ত দেব ,প্রাণ দেব তবু মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করে ছাড়ব। এইসময় চা নিয়ে ঘরে ঢোকে মুন্না। কারে রক্ত দেবেন? -ও তুই বুঝবি না।দে চা দে।ফিরোজ ওকে থামিয়ে দেয়। -হ আমি বুঝুম না। শুধু আপনারাই বোঝেন। লেখাপড়া জানেনতো তাই খালি আপনারাই বুঝবেন। রাগে গজগজ করে মুন্না বলে,খালি যদি লেখাপড়া জানতাম তাইলে দেইখতেন আমিও পোষ্টার লিখা পুরা ঢাকা শহরে লাগায় দিতাম। রাজীব আদর করে মুন্নাকে কাছে টেনে নেয়।রাগ করছিস কেন? তুই বা কম করছিস কিসে!পোষ্টারগুলো আমাদের সাথে মিলে দেয়ালে লাগাচ্ছিস। -তাইলে যে ফিরোজ ভাইজান কয় আমি কিছু বুঝবার পারিনা। -তুইতো অনেক বুঝিস। এই বয়সেই তুই আমাদের সাথে ভাষার জন্য আন্দোলন করছিস। -হইছে আর বুঝাইতে হইবো না। লন তাড়াতাড়ি চা শেষ কইরা কাপগুলা দেন।দোকানে দিয়া আসি।অনেক রাত হইছে। দোকান বন্ধ কইরবো।
এই দেখ আমার সাথে সাথে হাত ঘুরা। এইটা হল অ এইটা হল আ।রাজীব মুন্নাকে লেখা শেখানোর চেষ্টা করে। -না আমি পারুম না। -তোর লেখাপড়া করতে ভাল লাগে না ?ইচ্ছা হয় না ?রাজীব মুন্নাকে প্রশ্ন করে, তাইলে পোষ্টার লিখবি কেমনে! চিকা মারবি কেমনে? -হ এইটা ঠিক লেখাপড়া না শিখলে তো পোষ্টার লিখতে পারুম না দেয়ালে লিখতে পারুম না। তয় আমি মিছিল করব। -সেতো করিসই। নিজের ভাষায় কথা বলবি, লিখবি। দেখবি ওরা দাবী মেনে নিবে।
-হ আমি আমার মায়ের ভাষায় কথা বলুম,লিখৃুম। -কিন্তু কালি পাব কই? -এটা কোন বিষয় হল! -বারে লিখতে কালি কলম কাগজ লাগবে না! -হ্যা লাগবে।সেটা কোন সমস্যা হবেনা। আগে তুই লেখা শেখ।
-কিরে কি বুঝাচ্ছিস মুন্নাকে? শান্তর কথায় পিছন ফিরে তাকায় রাজীব। -আর বলিস না। ওরে অ আ লিখতে শিখাচ্ছি।ও বলে কিনা কালি পাবে কোথায়? -কালি পাবি কোথায় মানে? বজ্রকন্ঠে শান্ত জবাব দেয় আমাদের শরীর ভর্তি কালি। অবাক হয়ে দু"জনেই শান্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। -তার মানে? রাজীব জানতে চায়। -কেন রক্ত আছেনা! বিপ্লবী নেতার মতো বলতে থাকে শান্ত, আমরা রক্ত দিয়ে রাজপথ রাঙিয়ে দেব। আমাদের দাবী রক্ত দিয়ে রাজপথে লিখে দেবো।দেখিস একদিন রক্ত দিয়ে ইতিহাস লেখা হবে। হয়তো সেদিন আমরা থাকবো না। শান্ত যখন কথা বলে একটা অন্য রকম শিহরন বয়ে যায় রাজীবের শরীরে। শুধু রাজীব কেন, যখন কোন মিটিং এ সে বক্তৃতা দেয় সবাই তাতে উদ্বেলিত হয়। শিহরিত হয়। এ এক বিশেষ গুন আছে শান্তর মধ্যে রাজীব মনে মনে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে।
শান্তর কথাটা বেশ ভাবায় মুন্নাকে। তার শরীরে লেখার কালি। লাল লাল কালি। লাল রক্ত। মুন্না এখন অ আ ই লিখতে পারে। যেখানে কাগজ কলম পায় সেখানেই লিখে। কয়লা দিয়ে দেয়ালে লিখে।রাস্তার দেয়ালে ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে লিখে আ মরি বাংলা ভাষা। মা মাটি। তার মনে হয় পুরো ঢাকা শহরটাই যেন তার লেখার খাতা। সে যেখানে যা পায় তাই দিয়ে লেখে রাস্তায়। ভাঙা ইটের টুকরো,কাঠ কয়লা দিয়ে দেয়ালে। এ যেন এক অন্যরকম খেলা। ভাষা নিয়ে খেলা। মায়ের ভাষা এত সুন্দর। সে রাজীব ভাইয়ের জন্য দোয়া করে। সে তাকে লেখা শিখিয়েছে। সুন্দর সুন্দর ছড়া শিখিয়েছে। মায়ের ভাষায় এত সুন্দর সুন্দর ছড়া। সত্যিই অপূর্ব!
লিখতে তার এখন এত ভাল লাগে যে তার ইচ্ছে হয় সারাদিনই লিখতে। তাই যখনই যা পায় তাই দিয়ে লিখে। সেদিন হঠাৎ একটা ইটের টুকরায় তার পা কেটে গেল।গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল। সে সেটা চেপে না ধরে সেখান থেকে রক্ত আঙ্গুলে নিয়ে লিখলো অ আ ক মা...
এখন সে পোষ্টার লিখে। যদিও লেখা সুন্দর হয়না। অনেক সময় লাগে।
প্র্রতিদিনই মিছিল মিটিং চলছে। সেসবের সামনেই থাকে ১০-১২ বছরের ছোট্ট মুন্না।
কাল বিরাট মিছিল হবে। সরকার ১৪৪ ধারা জারী করেছে। তবুও মিছিল হবে।
মুন্না পোষ্টারের কাগজ আনতে যায় দোকানে। কাগজ কিনে ফিরতে থাকে হোস্টেলে। নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার। হোষ্টেলের বড় ভাইরা তাকে বেশ আদর করে,তাকে সমীহ করে। তাকে দিয়ে পোষ্টারের কাগজ কিনে আনে। নিজেকে গর্বিত মনে হয় তার। তার ফেরার পথে পথরোধ করে দাঁড়ায় পৃুলিশ।
দুদিন পর ফেব্রুয়ারীর ২২ তারিখে বিকেলে পুকুরের পাড়ে পাওয়া যায় রক্তাক্ত পোষ্টার।রক্ত দিয়ে লেখা অসম্পূর্ণ বর্ণমালা অ অ ক খ সেই পোষ্টারে। বাকি পোষ্টারগুলো রক্তে ভিজে গেছে। শুকিয়ে গেছে জমাট বাধা রক্ত। রাজীব সেটা নিয়ে আসে হোষ্টেলে । বন্ধুদের দেখায়।
চিরদিনের মত হারিয়ে যায় মুন্না। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জানা হয় না তার পরিনতি সম্পর্কেও। জানতে পারা যায়না কি হয়েছিল সেদিন? মুন্নাকেই বা কি করা হয়েছিল ? তাকে কি মেরে ফেলে লাশ নদীতে কিংবা পুকুরে ফেলে দেয়া হয়েছিল। নাকি রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে গেছিল পুলিশ। তার নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তার প্রিয় মাতৃভাষার অক্ষর লিখে গিয়েছিলো পোষ্টারে। মৃতু্যর আগে।
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পুরনো হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায়। স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যায়।হারায় না শুধু ত্যাগের মহিমা।রয়ে যায রক্তাক্ত সেই পোস্টারটি। সেই পোষ্টারটি এখন শোভা পাচ্ছে রাজীব রায়হানের সন্তানের আভিজাত্য ঘেরা বাড়ির বিশাল ড্রইংরুমে। রাজীব রায়হান অনেক আগেই গত হয়েছেন। তার নাতী নাতনীরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছে। তারা বাংলার চেয়ে ইংরাজীতেই বেশী কথা বলে। বিদেশী খাবার পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ঘরের এই পোষ্টারটি না থাকলে হয়তো কখনোই জানা যেতনা তারা ভাষা সৈনিকের উত্তরসূরী। বাড়ির কাজের লোক দিয়ে প্রতিদিন দু"তিনবার মুছে পরিস্কার করা হয় পোষ্টারটি। আজও একটু আগেই পরিস্কার কাপড় দিয়ে মোছা হয়েছে পোষ্টারটি। এভাবেই হয়তো চলতে থাকবে বংশ থেকে বংশে পোষ্টারটি আর দূরে সরে যেতে থাকবে প্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার আগ্রহ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Azaha Sultan
অনেক ভাল লাগল......তবে ভাষাসৈনিকের উত্তরসূরিরা অনেকেই বাংলা ভুলে যাচ্ছে....প্রাণ দেওয়া প্রাণের চেয়ে প্রিয় পূর্বপুরুষের কথা ভুলে যাচ্ছে......
সাইফুল করীম
বেদনাবিধুর গল্প। ভালো লাগল। পোষ্টার- পারিভাষিক শব্দ বিধায় মনে হয় পোস্টার হবে। কিছু মনে করবেন না-ধান ভানতে এসে শীবের গীত গাওয়ার জন্য। আর গীত তো মানুষ পছন্দের জিনিসের সাথেই করে-তাই নয় কি? ধন্যবাদ আপনাকে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।